শহীদুল জহিরের ডুমুর

শোয়েব সর্বনামের সাথে আমার মিল খুজে পাওয়া কঠিন।
শোয়েব কবিতা লেখে; আমি কবিতা পড়িও না। শোয়েব মদ খায়; আমি মদ ছুয়েও দেখি না। শোয়েবের অনেক তরুনী বন্ধু আছে; আমার তরুনী বা বৃদ্ধা, কোনো নারী বন্ধু নেই।
তারপরও সেবার ঈদের সময় যখন নড়াইল যাওয়া ঠিক হলো, আমি শোয়েবের সঙ্গী হলাম।
নড়াইল অবশ্য শোয়েবের জন্য নতুন কিছু না। এই জেলারই কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে তার আদি বাড়ি। সেখানে তাদের বিস্তর বিষয় সম্পত্তি আছে। কিন্তু শোয়েব সেই বিষয়ের খুব একটা খবর রাখে না। সে দায় তার বাবার। শোয়েব কতো বার নড়াইলে গেছে, সেটা আঙুল গুনে বলতে পারে। ফলে আমাদের সেই নড়াইল যাত্রা ছিলো নতুন করে পথ আবিষ্কারের মতো ব্যাপার।


প্রথমেই সংকট হলো, নড়াইল কোনো ভালো বাস যায় না।
আমরা আতিপাতি করে খুজলাম। কিন্তু সেই গরমের কালে কোথাও কোনো এসি বাস পাওয়া গেলো না। অবশেষে আরেক বন্ধুর পরামর্শে আমরা যশোরের বাসে চড়ে বসলাম।
আচ্ছা, আমরা কেনো, নড়াইল যাচ্ছিলাম, সেটা আগে একটু পরিষ্কার করে বলা যাক।
নড়াইলে আমরা শহীদুল জহিরের ডুমুরের খোজ করবো বলে রওনা হয়েছিলাম। ডুমুরের ব্যাপারটা আমি সেভাবে জানতাম না। শোয়েব আমাকে একদিন হঠাৎ বললো,
‘আপনি কী ডুমুরখেকো মানুষ গল্পটা পড়েছেন?’
দ্যাখেন, আমার পড়াশোনা এমনিতেই কম। তারওপর এই বাংলা সাহিত্যের কথা যদি বলেন, সে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। তাই মুখটা করুন করে বললাম,
‘কার লেখা, বলেন তো? মানিক নাকী?’
‘ধুর মিয়া। আপনি তো কোনো খবরই রাখেন না। এটা শহীদুল জহিরের লেখা।’
‘ও আচ্ছা।’
আমার প্রায় নির্লিপ্ত ‘ও আচ্ছা’ শুনে শোয়েব একটু আহত হলো। বললো,
‘আপনার উচিত কিছু পড়াশোনা করা।’
‘সে না হয় করবো নে। এবার বলেন, হঠাৎ ডুমুরের কথা এলো কেনো?’
‘নড়াইলের একটা গ্রামে ডুমুর খেলে লোকজন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সেখানে এক লোক ডুমুর বিক্রি করছে।’
এবার আমার হাসার পালা। বললাম,
‘শোয়েব, আজকের দিনে এসব বিশ্বাস করেন? কোথায় মানুষ ডুমুর কিনে সেটা খেয়ে অদৃশ্য হচ্ছে; তাই নিয়ে আলাপ!’
শোয়েব অধৈর্য্য হয়ে বললো,
‘শুধু আলাপ না। আমি ঠিক করেছি, নড়াইলে যাবো এই ডুমুর দেখতে।’
‘যান। আপনার জন্য শুভকামনা রইলো।’
শোয়েব এবার খাপ খুললো,
‘আমি একা যাবো না। আপনিও যাবেন।’
‘ধুর মিয়া। আমি বৌ—বাচ্চা আর অফিস সামলায়ে মরার সময় পাই না। আমি যাবো ডুমুর দেখতে!’
‘অফিস ওই সময় থাকবে না। আমরা ঈদের ছুটিতে যাবো।’
‘অফিস না থাকলেও বৌ বাচ্চা তো আছে।’
‘আমি বৌদিকে বলে ম্যানেজ করে দেবো। আপনার যাওয়া দরকার।’
‘আমার কেনো যাওয়া দরকার? আমি শহীদুল জহির পড়িনি। আমি ডুমুর খাই না। আমি কেনো নড়াইল যাবো?’
‘আপনি যাবেন মাশরাফির বাড়ি দেখতে।’
এটা একটা অবশ্য কাজের কথা হলো। আমি স্পোর্টস রিপোর্টার মানুষ। মাশরাফির বাড়িটা একবার দেখতে যাওয়া উচিত।


মাশরাফির সাথে কথা বলা মানেই নড়াইলের গল্প শোনা। ইনফ্যাক্ট আমি সুলতান বা বিজয় সরকারের নামও আগে সেভাবে শুনিনি। নড়াইল নামটা আমার কাছে প্রথম ভালোভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলো আমার মেজদার কল্যানে। এই নড়াইলে বিয়ে করেছে সে। আর নড়াইল মেজদার বিয়েতে গিয়ে শুনলাম, এই কাছেই কোথায় মাশরাফির বাড়ি।
সে দফা মাশরাফির বাড়ি যাওয়া হয়নি। পরে আরেক বার সুযোগ এসেছিলো। মাশরাফির বিয়ের সময় আর সব ক্রীড়া সাংবাদিকের মতো আমিও দাওয়াত পেয়েছিলাম। কিন্তু নানা কারণেই যাওয়া হয়নি। কিন্তু আগ্রহটা থেকে গিয়েছিলো। বিশেষ করে মাশরাফির মুখে চিত্রা নদীর গল্প এতো বার শুনেছি যে, অন্তত নদীটা দেখতে যাওয়া উচিত।
তারপরও ঈদের মহামূল্যবান তিনতে দিন ছুটি এভাবে ঘুরে নষ্ট করতে কার মন চায়, বলেন।
তাই না যাওয়ার ইচ্ছেটাই বেশী ছিলো। কিন্তু শোয়েব কিছুতেই ছাড়লেন না। বাসায় এসে হাজির হলেন। আমার বৌকে পটিয়ে ফেললো,
‘বৌদি, দাদা কিন্তু শুয়ে শুয়ে ওজন বাড়িয়ে ফেলছে। এরপর কবে হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবে।’
আমার বৌ এই হার্ট অ্যাটাক ব্যাপারটাকে ভয় পায়। তাই রাজী হয়ে গেলো। ছেলেটা একটু ঘ্যান ঘ্যান করেছিলো,
‘আমি যাবো, বাবা। আমিও নড়াইল যাবো।’
বিস্তর বুঝিয়ে তবে বাসা ছাড়তে হলো। ভোর বেলায় যশোরে গাড়ি থেকে নেমে ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ছিলো। কী দরকার ছিলো এই ছেলেটা—বৌ রেখে এই তেপান্তর পাড়ি দেওয়ার।
তেপান্তর মানে, আসলেই তেপান্তর।
যশোর থেকে নড়াইল যাওয়াটা বিশাল একটা ঝক্কির ব্যাপার; প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পথ। লোকাল বাস আছে; তাতে চড়া আর ছোটখাটো দু একটা যুদ্ধ জিতে ফেলা একই কথা। সে চেষ্টা খানিক সময় করে খান্ত দিলাম। এর মধ্যে বাসস্ট্যান্ডে দাড়িয়ে থাকা এক লোক বললো,
‘ইজি বাইকে যাবেন?
ইজি বাইক মানে হলো চার্জের ব্যাটারিতে চলা প্রায় রিকশা ধরণের এক বাহন। এই বাহনে করে এতো দূর পাড়ি দেওয়া যাবে?
লোকটা হেসে বললো,
‘এই পথ কোনো ব্যাপারই না। আমি তো সকালে আসলাম?’
শোয়েব বললো,
‘এই আইডিয়াটা খারাপ না। গল্প করতে করতে চলে যাওয়া যাবে।’
তাই হোক। শেষ পর্যন্ত আমরা সোবহানের ইজি বাইকে চেপে বসলাম; আমাদের ড্রাইভারের না সোবহান।
সারাটা পথ শোয়েব আমাকে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সব গল্প শোনাতে শোনাতে গেলো। সেটা ছিলো আমার জন্য একটা শিক্ষা সফরের মতো। শোয়েব নিজে অবশ্য বাংলা সাহিত্যের এই পাঠ বেশ আগে শেষ করেছে। এখন সে জাপান থেকে আমেরিকা; বিভিন্ন দেশের পোস্ট মর্ডান গল্প পড়ছে। আমাকে সেগুলোও শেখানোর চেষ্টা করলো। আমার তখন চোখের সামনে দুটো সাদা ভাত, আলু ভার্তা আর মাছের ঝোল দুলছে। দুপুরে খাওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। এই সময় কী আর পোস্ট মর্ডান গল্প জমে।
তারপরও শোয়েব আমাকে শহীদুল জহিরের ‘ডুমুরখেকো মানুষ’ গল্পটা শোনোর চেষ্টা করলো। এই ডুমুরের কথা শুনেই সোবহান বললো,
‘স্যার, আমাগো জয়নগরের ডুমুরের কথা শুনছেন?’
শোয়েব সাথে সাথে লোক পেয়ে গেলেন,
‘যে ডুমুর খেলে লোকজন অদৃশ্য হয়ে যায়?’
‘হ স্যার। তাই তো লোকে বলতিছে।’
‘আমরা তো সেই ডুমুর দেখতেই আসলাম।’
‘আজ যাবেন?’
শোয়েব প্রায় ‘হ্যা’ বলে ফেলেছিলো। আমি আপত্তি করলাম,
‘আজ আর শরীরে কুলাবে না। কাল যাই।’
সোবহান বললো,
‘কাল গেলে তো কাল রাতেও থাকতি হবে। ওই ফকির বাবা তো শুধু সন্ধে বেলায় ডুমুর দেয়।’
শোয়েব একটু অবাক হলো,
‘ডুমুর বিক্রি করে না?’
‘নাহ, নাহ। আমি শুনিছি ফ্রি দেয়।’
‘কিন্তু লোকে নেয় কেনো? লোকে কী অদৃশ্য হতে চায়?’
‘না, না। স্যার। কেউ তো খায় না। সবাই নিয়ে বাড়ি রেখে দেয়। কোনো বিপদে পড়লে যাতে কাউরে খাওয়ায়ে দেয়া যায়।’
আমার এসব আজগুবি কথা শুনেই মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো। তারপরও শোয়েবের আগ্রহ। সে বললেণা,
‘ঠিক আছে। তুমি আমাদের সার্কিট হাউজে নামায়ে দাও। আমরা খেয়ে একটু রেস্ট নেই। তারপর সন্ধে বেলায় যাবো। তুমি চেনো তো?’
সোবহান এক গাল হেসে বললো,
‘সে চিনে নেবানে।’


সার্কিট হাউজের পরিবেশটা দারুন।
আমাদের এই সার্কিট হাউজটা ঠিক করে দিয়েছেন সাদেক ভাই। উনি আমাদের পত্রিকার নড়াইল প্রতিনিধি। প্রথমে পরিকল্পনা ছিলো যে, একটা হোটেলে উঠবো। পরে সাদেক ভাইকে ফোন করলে বললেন, তেমন ভালো হোটেল তো এখানে নেই; সার্কিট হাউসে ব্যবস্থা করে দেবো।
ব্যবস্থা দিব্যি। আমাদের একটা ডাবল রুম দেওয়া হলো। বেশ গদি ওয়ালা দুটো বিছানা, একটা ওয়ার্ডরোব, কাবার্ড এবং ভালো একটা অ্যাটাচ টয়লেট। সামনেই একটা হোটেলে খাওয়ারও বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। সবমিলায়ে ব্যবস্থা বেশ ভালো।
আরামে একটু চোখ বুজে এসেছিলো। আমার আবার ছুটির দিনে দুপুরে খাওয়ার পর একটু ঘুম দিতে পারলে স্বর্গে আছি বলে মনে হয়। সেই ঘুমটার সর্বনাশ করলো সোবহান। রুমের সামনে এসে চিল্লা পাল্লা শুরু করলো। শোয়েব উঠে দরজা খুলে দিতেই বললো,
‘তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। নইলে রাত হয়ে যাবে।’
ঝটপট তৈরী হয়ে নিলাম। যাওয়ার পথে শোয়েবকে বললাম,
‘কাল সকালে কিন্তু মাশরাফির বাড়ি যাবো। ওর সাথে কথা হয়েছে। সেও ছুটিতে বাড়ি আছে।’
শোয়েবের মাথা জুড়ে তখন ডুমুর ফল।
কিন্তু ডুমুর ফল তো এতো সোজা না। জয়নগর বাজারে পৌছানোর পর শুরু হলো সংগ্রাম। প্রথমে ফকির বাবার সন্ধান পাচ্ছিলাম না। পরে ডুমুরের কথা শুনে একজন বললো,
‘সে তো ভন্ড। একদিন গ্রামের লোকজন ধাওয়া দেওয়ায় পালিয়ে গেছে। ওসব বুজরুকি এখন চলে নাকি?’
আমি শোয়েবের দিকে চেয়ে হাসলাম।
এর মধ্যে পাশ থেকে একজন বললো,
‘না, আবার বাড়ি ফিরে এসেছে।’
ধুর। সেই কাচা রাস্তা ঠেঙ্গিয়ে পৌছালাম সেই ডুমুর বাবার বাড়ি।
সন্ধে হয়ে এসেছে। সম্ভবত কৃষ্ণপক্ষ। সন্ধেতেই রীতিমতো অন্ধকার। এর মধ্যে টিম টিম করে জ্বলছে ঘরের একটা আলো। সোবহান ডাক দিলো,
‘ফকির বাবা বাড়ি আছেন?’
দুই তিন বার ডাকাডাকি করার পর একটা লোককে দরজায় দেখা গেলোÑএকটা সাদা কাপড় ভাজ দিয়ে লুঙ্গির মতো করে পরা, মাথায় লম্বা লম্বা চুল; একেবারে ছবির ফকিরদের মতো বেশ।
শোয়েব এগিয়ে গিয়ে বললো,
‘আপনি কী ডুমুর বাবা?’
লোকটা খ্যাক করে উঠলো,
‘কীসের ডুমুর বাবা!’
‘না, আমরা শুনলাম, আপনি নাকি ডুমুর দেন। যেটা খেলে মানুষ অদৃশ্য হয়ে যায়?’
‘এই যুগে এটা শুনে আপনেরা আমার বাড়ি চলে আসছেন?’
শোয়েব খুব হতাশ,
‘ডুমুরের গল্পটা তাহলি সত্যি না?’
‘এইসব গল্পই হয়। গল্প কোনোদিন সত্যি হয় না।’
আমি একটু চেপে ধরে বললাম,
‘তাহলে এই গল্পটা ছড়ালো কী করে? আমরা তো অনেকের কাছেই শুনলাম।’
লোকটা বললো,
‘ভিতরে আসেন। বসেন।’
আমরা বসলাম। একটু স্বস্তি পেলাম যে, এই ডুমুরের গল্পটা সত্যি না।
লোকটা নিজে থেকেই বললো,
‘এটা আমার ছোট ভাইয়ের বুজরুকি। আমি একটু মারফতি লাইনের লোক। গান বাজনা করি; বাউল আর কী। আর আমার ছোট ভাইটা করে বুজরুকি।’
‘বলেন কী!’
‘হ্যা। কোত্থেকে ঘুরে এসে এলাকার লোকদের বললো, সে জাদু টোনা শিখেছে। সামনের ওই ডুমুর গাছ থেকে ফল পেড়ে লোকেদের দিতো।’
‘সেই ফল খেয়ে কেউ অদৃশ্য হতো?’
‘অদৃশ্য হবে কেনো? ডুমুর খেয়ে কেউ অদৃশ্য হয় নাকী! এসব কথা কী বলেন।’
‘আপনি খেয়েছেন ওই ডুমুর?’
‘খাবো না কেনো? আমাদের বাড়ির গাছ। আপনিও খান। এই নেন।’Ñবলে এগিয়ে গিয়ে গাছ থেকে এক থোকা ডুমুর এনে দিলো লোকটা আমাদের হাতে। নিজে একটা খেয়েও ফেললো।
শোয়েবকে দিয়ে বললো,
‘খান।’
শোয়েব খেয়েও ফেললো। কিছুই হলো না। জলজ্যান্ত শোয়েব আমার সামনে বসে রইলো।
শোয়েবের মনটা খুব খারাপ হলো। এতোদূর এসে একজন শহীদুল জহিরের দেখা পেলো না। আমার অবশ্য ভালোই লাগছে।
সোবহানকে বলে দিলাম,
‘কাল সকালে মাশরাফির বাড়ি যাবো। তুমি এসে নিয়ে যেও।’
কিন্তু সকালেই বাধলো ঝামেলা। শোয়েব বিছানায় নাই। তার মানে বাথরুম আটকে বসে আছে। আমার আবার ঘুম থেকে উঠেই বাথরুমে যেতে হয়। এটা একটা বিরাট ঝামেলা।
বাথরুমের দরজায় উঠে কয়েকটা টাক দিলাম। ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। নব ধরে ঘুরালাম। ভেতর ফাকা। শোয়েব গেলো কোথায়?
দরজাও তো ভেতর থেকে বন্ধ করা।


শোয়েবের বিছানায় তাকালাম একটা ডুমুর পড়ে আছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *