আনন্দবাজারের আনন্দ

অসমর্থিত ইতিহাস বলে, আমাদের যশোর জেলায় আনন্দবাজার বলে একটি এলাকা ছিল; মূলত বৃহৎ এক বারবনিতালয়ের কারণেই সে এলাকার প্রসৃদ্ধি।

স্মরণ করা যায়, এই যশোর থেকে কলকাতায় স্থানান্তিরত হওয়া সেন বাবুরা কালক্রমে কলকাতায় আনন্দবাজার বলে একটি পত্রিকা চালু করেন। দুমূর্খেরা বলে, এই আনন্দবাজারের নাম সেই বারবনিতালয়ের নাম থেকেই এসেছে!

এ কথা সত্যি কি না; সে বিচার করার দায় ঐতিহাসিকদের। আনন্দবাজার পত্রিকা ইদানিং আমাদের আলোচ্য হয়েছে অন্য কারণে।

সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকায় হুমায়ুন আহমেদের নাম ও পরিচয় বিকৃত করা নিয়ে আমাদের এখানে বেশ আলোচনা হচ্ছে। অনেকে খুব বিস্ময়ের সঙ্গে বলছেন, আনন্দবাজার পত্রিকা এমন করতে পারল!

পারল।

আনন্দবাজার এসব খুব পারে। আনন্দবাজার চিরকালই বাংলাদেশ, বাঙ্গালী মুসলমান নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকে। এটা তাদের আজকের স্বভাব নয়।

পত্রিকাটির দর্শনই হল, হিন্দু জাতীয়তাবাদী একটি দর্শন। যে সুবাদে সেই ১৯৭১ সাল থেকে তারা বাংলাদেশের অস্তিত্ত্ব নিয়ে এ ধরণের ঠাট্টা মশকরা করে আসছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত নিজস্বার্থে হোক আর মঙ্গল চেয়ে হোক আমাদের অস্ত্রে, অর্থে, ত্রানে, আশ্রয়ে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। ভারতের নানা গোষ্ঠীর কাছ থেকে তখন আমরা অবিস্মরনীয় সব উপকার পেয়েছি। কিন্তু সেই সময় এই আনন্দবাজার গোষ্ঠীর পত্রিকা দেশ পত্রিকায় বিশিষ্ট জন্মপরিচয়বিদ্বেষী লেখক নিরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছিলেন: ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’!!!

পড়ুন ‘হ্যাঁ, আমিই দ্বেষ পত্রিকার সম্পাদক!’: আহ্সান কবীর

সে জবাবে আনন্দবাজারের লেজ যে সোজা হয়নি, তা গত কয়েক বছরে আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝেছি।

অভিজ্ঞতাগুলো ভুলে যেতে চাইতাম। হঠাৎ প্রিয় কবি ও লেখক আখতারুজ্জামান আজাদের একটা স্টাটাস দেখে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর উন্নাসিকতার কথা আবার মনে পড়ে গেল।

আজাদ সাহেবের স্টাটাসটা দেখুন:

বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম কবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে দেখা হলে তিনি আন্তরিকভাবে কথা বলেন, আড্ডা দেন, অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, অনুজদেরকে পরামর্শ দেন, প্রশংসা করেন।

পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয়তম কবি সুনীল গঙ্গোঁপাধ্যায়কে (২১ জানুয়ারি ২০১০) একটা কবিতা হাতে দিয়ে বলেছিলাম, “দাদা, কবিতাটা একটু পড়ে দেখবেন কেমন হয়েছে?” তিনি বললেন, “পড়ার সময় নেই আমার।” বললাম, “ঠিক আছে, রেখে দিন দাদা, পরে পড়ে দেখবেন নাহয়…?”

সুনীল বললেন, “আরে ভাই, বললাম তো, আমার সময় হবে না!”

খানিক বাদে সুনীল মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিলেন, “আমাদের তরুণসমাজকে জেগে উঠতে হবে, প্রবীণদেরকে তরুণদের বিকাশলাভে সাহায্য করতে হবে…”

সুনীলের বা সুনীলদের; যারা এই বঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ওখানে গিয়ে এখন কেউকেটা; তাদের এই আচরণ জানার পরও আমার আদের প্রতি রাগ হয় না। রাগ হয় আমাদের প্রতি। এই আমরা, ওনারা এখানে এলে বা আমরা ওখানে গিয়ে তাদের ‘দাদা, দাদা’ বলে মাথায় তুলি। তাদের আগমনে আমাদের বৃহৎ সংবাদমাধ্যমগুলো কেপে কেপে ওঠে। তাদের ছাড়া এখন দেখছি ঈদের অনুষ্ঠানও জমছে না। আমাদের এই অপাত্রে আদিখ্যেতা তাদের আরও উন্নাসিক এবং ‘আমি কি হনু রে’ করে তুলছে।

আমরা ভুলে যাই, আমাদের একজন আখতারুজ্জামান আজাদও একজন জাতীয় কবি; কিন্তু সুনীল একজন মৃত আঞ্চলিক কবি, একজন গৌন প্রাদেশিক গদ্যকার এবং একটি প্রাদেশিক পত্রিকার চাকুরে। সম্মানের বিচারে আমিও তার চেয়ে বেশি দাবি করি। কারণ, আমি একটি জাতীয় পত্রিকায় কাজ করি; আনন্দবাজারের মতো আঞ্চলিক পত্রিকায় নয়!

নামের বানান বদলানো প্রসঙ্গে বলি; মুসলিম নামের ক্ষেত্রে ইচ্ছে করে এই বদমায়েশীটা করে ওরা। এটা চরম উন্নাসিকতার পরিচায়ক। ওয়াসিম আকরামকে লিখবে আক্রম! আমাদের মাশরাফিকে লিখবে মুশরফি। না জেনে এমন করলে কথা ছিল না। আমি একটা ঘটনা বলি, পবিত্রদা (কুন্ডু) একবার আনন্দবাজারে একটি অতিথি কলাম লিখলেন। লেখার শেষে নোট আকারে লিখে দিলেন: আমাদের খেলোয়াড়দের নামের বানান আসলে এই, আশা করি এটা বদলানো হবে না। তারপরও তারা নামগুলো বদলেছিল।

সর্বশেষ আরেকটা উদাহরন। এবারের বিশ্বকাপ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। টেলিগ্রাফ, বিবিসি, ক্রিকইনফো, সিডনি মরনিং হেরাল্ড সবার রিপোর্ট পড়ুন। দেখবেন ঢাকা অনুষ্ঠান নিয়ে সবাই মোহিত। ব্রিটিশ এক অভিনেতা-সাংবাদিক জ্লাতমান তার জীবনে দেখা সেরা উৎসব বলেছিলেন অনুষ্ঠানটাকে।

একই অনুষ্ঠান কাভার করে আনন্দবাজারের গৌতম ভট্টচার্য্য যে লেখা লিখলেন, তাতে সাংবাদিকদের একটু হেটে ঢোকার কষ্টের বর্ননা নিয়েই কাসুন্দি। এই লিখে পুরো লেখাটাকে অব্যবস্থাপনার একটা দলিল হিসেবে উপস্থাপন করলেন। ভাবখানা এই যে, পুরো আয়োজনটি হয়েছিল সাংবাদিকদের আরাম দিতে; সেটা না হওয়ায় অনুষ্ঠান ব্যর্থ!

অথচ এই গৌতমরা ভুলে যান, ১৯৯৬ সালে কলকাতা বিশ্বকাপের ওপেনিং করতে গিয়ে লেজার শোর নামে কেলেঙ্কারি করে ফেলেছিল। সেদিন সারা পৃথিবীতে ‘ছি ছি’ পড়ে গিয়েছিল। সেখানে ঢাকা কয়েক শ ধাপ এগিয়ে গেল এবার। সেটা ওনাদের পছন্দ হয় না। অথচ এই আমরা; ক্রীড়া সাংবাদিকরা আবার ওনাদের দেখলেই লালায়িত হয়ে পড়ি: দাদা এসছেন!!!

আমরা জানলেও প্রায়ই ভুলে যাই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মর্যাদায় আমাদের সাদেক হোসেন খোকার সমতূল্যও নন। খোকা রাজধানীর মেয়র আর মমতা ভারতের অন্যতম পশ্চাপদ একটি রাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী। মমতা আসবেন বলে সেজে ওঠার কিছু নেই।

আসলে আজ থেকে হলেও আমাদের একটা কথা বুঝতে হবে; পশ্চিম বাংলা আমাদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর ওরা হাজার স্বপ্ন নিয়েও একটা রাষ্ট্রের অধীন অংশ মাত্র।

কাউকে তার প্রাপ্যর চেয়ে বেশি মর্যাদা দিলেই মাথায় চড়ে বসে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *